মাতা – পিতার জন্য সন্তানের করণীয় এবং সন্তানের জন্য পিতা – মাতার করণীয় তথা মাতা – পিতা ও সন্তানের অধিকার সমূহ | The rights of parents and children

The rights of parents and children

মাতা – পিতার জন্য সন্তানের করণীয় (Parents – what to do for the child)

১. যদি মাতা – পিতার প্রয়োজন হয় এবং সন্তান তাঁদের ভরণ – পোষণ দিতে সক্ষম হয় , তাহলে মাতা – পিতার ভরণ – পোষণ দেয়া সন্তানের উপর ওয়াজিব । এমনকি পিতা – মাতা কাফের হলেও তাদের ভরণ – পোষণ দেয়া ওয়াজিব ।
২. প্রয়োজন হলে মাতা – পিতার খেদমত করা দায়িত্ব । খেদমত নিজে করতে পারলে করবে নতুবা খেদমতের জন্য লোকের ব্যবস্থা করা দায়িত্ব । উল্লেখ্য যে , খেদমতের ক্ষেত্রে পিতার তুলনায় মাতাকে প্রাধান্য দিতে হবে ।
৩. পিতা – মাতা ডাকলে তাদের ডাকে সাড়া দেয়া এবং হাজির হওয়া । এমনকি পিতা – মাতা যদি কোন অসুবিধায় পড়ে বা অসুবিধার ভয়ে সহযোগিতার জন্য ডাকেন আর অন্য কেউ তাদের সহযোগিতা করার মত না থাকে , তাহলে ফরয নামাযে থাকলেও তা ছেড়ে দিয়ে তাদের সাহায্যে এগিয়ে যাওয়া ওয়াজিব । তবে জরুরত ছাড়া যদি ডাকেন তাহলে ফরয নামায ছাড়া জায়েয হবে না । আর নফল বা সুন্নাত নামাযে থাকা অবস্থায় বিনা জরুরতে পিতা – মাতা ডাকলে তখনকার মাসআলা হল – যদি সে নামাযে আছে একথা না জেনে ডেকে থাকেন তাহলে নামায ছেড়ে তাদের ডাকে সাড়া দেয়া ওয়াজিব । আর যদি নামাযে আছে একথা জেনেও বিনা জরুরতে ডাকেন , তাহলে সেরূপ ক্ষেত্রে নামায ছাড়বে না । দাদা – দাদী , নানা – নানীর ক্ষেত্রেও মাসআলা অনুরূপ ।
৪. মাতা – পিতার হুকুম মান্য করা ওয়াজিব , যদি কোন পাপের বিষয়ে হুকুম না হয় । কেননা , পাপের বিষয়ে হুকুম হলে তা মান্য করা নিষেধ । মোস্তাহাব পর্যায়ের ইল্ম হাছিল করার জন্য সফর করতে হলে তাদের অনুমতি প্রয়োজন । তবে ফরযে আইন ও ফরযে কেফায়া পরিমাণ ইলম হাছিল করার জন্য সফর করাটা তাদের অনুমতির উপর নির্ভরশীল নয় । এ সম্পর্কে অত্র গ্রন্থের শুরুতে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে ।
৫. পিতা – মাতার সঙ্গে সম্প্রীতি ও ভক্তির সাথে নম্রভাবে কথা বলা আদব । রূঢ়ভাবে ও ধমকের স্বরে কথা বলা নিষেধ । ৬. কথায় , কাজে ও আচার – আচরণে পিতা – মাতার আদব – সম্মান রক্ষা করা । এ জন্যেই তাঁদের নাম ধরে ডাকা নিষেধ , চলার সময় তাঁদের পশ্চাতে চলা উচিত , তাঁদের সামনে নিম্ন স্বরে কথা বলা উচিত , তাঁদের দিকে তেজ দৃষ্টিতে তাকানো অনুচিত । উল্লেখ্য যে , সম্মানের ক্ষেত্রে মাতার তুলনায় পিতাকে প্রাধান্য দিতে হবে ।
৭. কোনভাবে তাঁদেরকে কষ্ট দেয়া হারাম । মাতা – পিতা অন্যায়ভাবে কষ্ট দিলেও তাঁদেরকে কষ্ট দেয়া যাবে না । এমনকি মৃত্যুর পরও তাঁদেরকে কষ্ট দেয়া নিষেধ , এ জন্যেই তাঁদের মৃত্যুর পর চিৎকার করে কাঁদা নিষেধ । কারণ তাতে তাঁদের রূহের কষ্ট হয় ।
৮. নিজের জন্য যখনই দু’আ করা হবে , তখনই পিতা – মাতার মাগফেরাতের জন্য , তাঁদের প্রতি আল্লাহর রহমতের জন্য এবং তাঁদের মুশকিল আছান ও কষ্ট দূর হওয়ার জন্য দু’আ করা কর্তব্য । তাঁদের মৃত্যুর পরও আজীবন তাঁদের জন্য এরূপ দু’আ করতে হবে । জনৈক তাবিঈ বলেছেন , যে প্রতিদিন অন্ততঃ পাঁচ বার পিতা – মাতার জন্য দুআ করল , সে পিতা – মাতার হক ( অর্থাৎ , দুআ বিষয়ক হক ) আদায় করল । পিতা – মাতার জন্য দুআ করার বিশেষ বাক্যও আল্লাহ শিক্ষা দিয়েছেন । তা হল- এ দু’আর মধ্যে পিতা – মাতার প্রতি আল্লাহর রহমত কামনা করা হয় । তবে এখানে উল্লেখ্য যে , পিতা – মাতা অমুসলমান হলে তাঁদের জীবদ্দশায় এ রহমতের দু’আ এই নিয়তে জায়েয হবে যে , তারা পার্থিব কষ্ট থেকে মুক্ত থাকুন এবং ঈমানের তাওফীক লাভ করুন । মৃত্যুর পর তাঁদের জন্য রহমতের দু’আ করা জায়েয নয় ।
৯. পিতা – মাতার খাতিরে পিতা – মাতার বন্ধু – বান্ধব ও প্রিয়জনের সাথে এবং পিতা – মাতার ঘনিষ্ঠজনদের সাথে ভাল ব্যবহার করা , সম্মানের ব্যবহার করা এবং সাধ্য অনুযায়ী তাদের উপকার ও সাহায্য করা কর্তব্য ।
১০. পিতা – মাতার ঋণ পরিশোধ করা এবং তাঁদের জায়েয ওছিয়াত পালন করাও তাঁদের অধিকারের অন্তর্ভুক্ত । বিঃ দ্রঃ দুধ মাতার সাথেও সদ্ব্যবহার করতে হবে । তাঁর আদব তাযীম রক্ষা এবং যথাসাধ্য তাঁর ভরণ – পোষণ করতে হবে । আর বিমাতা নিজের আপন মাতা না হলেও যেহেতু সে পিতার প্রিয়জনের মধ্যে একজন , তাই তাঁর সাথে সদ্ব্যবহার এবং যথাসাধ্য তার জানে মালে খেদমত করতে হবে ।

সন্তানের জন্য পিতা – মাতার করণীয় (Parents for their children)

১. সুসন্তানের জন্য একজন সুন্দর মাতার ব্যবস্থা করাঃ অর্থাৎ , শরীফ ও নেককার নারীকে বিবাহ করা , তাহলে তার গর্ভে সু – সন্তানের আশা করা যায় । কেননা সন্তান গর্ভে থাকা অবস্থাতেই মাতার চিন্তা – ভাবনা , মন মানসিকতা ও স্বভাব – চরিত্রের প্রভাব সন্তানের উপর পড়া শুরু হয় এবং মাতৃকোলে লালন – পালন অবস্থাতেও এই প্রভাব পড়তে থাকে ।
২. সন্তানের জীবন রক্ষা করা : ইসলাম জাহেলী যুগের সন্তান হত্যা করার রছমকে তাই হারাম করেছে । সন্তানের জীবন রক্ষার সম্ভাব্য সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা মাতা – পিতার দায়িত্ব । সন্তানের উপর থেকে বালা – মুসীবত যেন দূর হয়ে যায়- এ উদ্দেশ্যে সন্তানের আকীকা করাকে সুন্নাত করা হয়েছে ।
৩. সন্তানকে লালন – পালন করাও মাতা – পিতার দায়িত্ব । এজন্য মাতার উপর দুধপান করানোকে ওয়াজিব করা হয়েছে । মাতার বর্তমানে বা তাঁর অপারগতার অবস্থায় দুধমাতার মাধ্যমে সন্তানকে দুধ পান করানো হলে তার ব্যয়ভার বহন করা সন্তানের পিতার উপর ওয়াজিব । উল্লেখ্য যে , দুধমাতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে সূচরিত্রবান ও দ্বীনদার মহিলাকে নির্বাচন করা কর্তব্য । কারণ , বাচ্চার চরিত্রে দুধের একটা বিরাট প্রভাব রয়েছে । এমনিভাবে সন্তানের লালন – পালন হালাল সম্পদ দ্বারা হওয়া চাই , নতুবা সন্তান বড় হওয়ার পর তার মধ্যে হালাল – হারাম – এর পার্থক্য করার প্রবৃত্তি থাকবে না ।
৪. সন্তানকে আদর সোহাগের সাথে লালন – পালন করা কর্তব্য । কেননা আদর সোহাগ থেকে বঞ্চিত হলে সন্তানের স্বভাব – চরিত্রে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে ।
৫. সন্তানের ভাল নাম রাখা মাতা – পিতার দায়িত্ব এবং এটা সন্তানের অধিকার । এর দ্বারা বরকত হাছিল হবে ।
৬. সন্তানকে সুশিক্ষা প্রদান করা : সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সাথে সাথেই এ শিক্ষা প্রদান শুরু হবে । তাই সন্তান ছেলে হোক বা মেয়ে ভূমিষ্ঠ হওয়ার সাথে সাথেই তার ডান কানে আযানের শব্দগুলো এবং বাম কানে ইকামতের শব্দগুলো শোনানো সুন্নাত করা হয়েছে । বলাবাহুল্য , এ শব্দগুলোর একটা সুপ্রভাব তার মধ্যে পড়বে । সন্তানকে সর্বপ্রথম যে কথাটা শেখানো উত্তম তা হল “ লাইলাহা ইল্লাল্লাহ ” । সন্তানকে কুরআন শিক্ষা দেয়া এবং ইল্‌মে দ্বীন শিক্ষা দেয়া কর্তব্য করে দেয়া হয়েছে । সন্তানদের দুনিয়াবী হকের মধ্যে রয়েছে তাদেরকে সাঁতার কাটা , জীবিকা উপার্জনের জন্য কোন বৈধ পেশা প্রভৃতি প্রয়োজনীয় বিষয় শিক্ষা দেয়া ।
৭. সন্তানকে আদব , আমল ও সূচরিত্র শিক্ষা দেয়া । দুধের শিশু অবস্থা থেকেই তার আদব ও চরিত্র শিক্ষা শুরু হয়ে যায় । তাই ইসলামী নীতিতে বলা হয়েছে দুগ্ধপোষ্য শিশুর জাগ্রত থাকা অবস্থায়ও তার সামনে মাতা – পিতা যৌন আচরণ থেকে বিরত থাকবে , নতুবা ঐ সন্তানের মধ্যে নির্লজ্জতার স্বভাব জন্ম নিতে পারে । সন্তানের সাত বৎসর বয়স হলে তাকে নামাযের নির্দেশ প্রদান এবং দশ বৎসর হলে মারপিট ও শাসনপূর্বক তার দ্বারা নামায পড়ানো- এগুলো সন্তানকে আমল শিক্ষা দেয়ার অংশ বিশেষ । সন্তানকে লালন – পালন , সুশিক্ষা প্রদান এবং আদব , আমল ও সূচরিত্র শিক্ষা দেয়া
৮. সন্তানদের মধ্যে ইনসাফ রক্ষা করা : সন্তানদেরকে ধন – সম্পদ দান প্রভৃতি ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে সমতা রক্ষা করা ভাল । তবে কোন সন্তান তালিবে ইল্ম হলে সে যেহেতু দ্বীনের কাজে নিয়োজিত থাকার দরুণ জীবিকা উপার্জনে স্বাভাবিকভাবে পিছিয়ে থাকবে , তাই তাকে কিছু বেশী দান করে গেলে কোন অন্যায় হবে না । এমনি ভাবে কোন সন্তান রোগের কারণে বা স্বাস্থ্যগত কারণে উপার্জন করতে অপারগ হলেও তাকে কিছু বেশী দেয়া যায় ।
৯. বিবাহের উপযুক্ত হলে বিবাহ দেয়া । তবে বিবাহের খরচ বহন করা পিতা / মাতার দায়িত্ব নয় ।
১০.কন্যা বিধবা কিংবা স্বামী পরিত্যক্তা হলে পুনঃবিবাহ পর্যন্ত তাকে নিজেদের কাছে রাখা এবং তার প্রয়োজনীয় ব্যয়ভার বহন করা পিতা – মাতার দায়িত্ব ।